
এখন আয়করের যে ধাপ আছে সেখানে সাড়ে তিন লাখ থেকে সাড়ে চার লাখ টাকার মধ্যে বার্ষিক আয় থাকলে করদাতাদের পাঁচ শতাংশ হারে আয়কর দিতে হয়।
এর পরবর্তী চার লাখ টাকার (মোট আয় সাড়ে আট লাখ টাকা) ওপর ১০ শতাংশ, পরবর্তী পাঁচ লাখের (মোট আয় সাড়ে ১৩ লাখ টাকা) ওপর ১৫ শতাংশ, পরবর্তী পাঁচ লাখের (মোট আয় সাড়ে ১৮ লাখ টাকা) ওপর ২০ শতাংশ এবং অবশিষ্ট আয়ের ওপর ২৫ শতাংশ হারে আয়কর নির্ধারণ করা আছে।
নতুন কর কাঠামো অনুযায়ী করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়িয়ে করা হতে পারে তিন লাখ ৭৫ হাজার টাকা।
তবে প্রথম স্তরে এর পরের তিন লাখ ১০ হাজার টাকা আয়ের জন্য (মোট আয় ছয় লাখ ৮৫ হাজার টাকা পর্যন্ত) ১০ শতাংশ হারে কর, তার পরের চার লাখ টাকার ওপর (মোট ১০ লাখ ৮৫ হাজার টাকা পর্যন্ত) ১৫ শতাংশ হারে কর, পরবর্তী পাঁচ লাখ টাকার ওপর (মোট ১৫ লাখ ৮৫ হাজার টাকা পর্যন্ত) ২০ শতাংশ হারে কর এবং তার পরের ২০ লাখ টাকার ওপর (মোট ৩৫ লাখ ৮৫ হাজার টাকা পর্যন্ত) ২৫ শতাংশ হারে কর এবং এর ওপরে থাকা আয়ের জন্য ৩০ শতাংশ হারে কর নির্ধারণের খবর গণমাধ্যমে এসেছে।
আয়কর আইন বিশেষজ্ঞ স্নেহাশীষ বড়ুয়া বলছেন, প্রস্তাবিত অর্থ অধ্যাদেশ ২০২৫ বেতনভোগী করদাতাদের জন্য একটি বড় আঘাত নিয়ে আসতে পারে বলে তিনি ধারণা করছেন।
"এমনিতেই মূল্যস্ফীতির চাপে দিশেহারা তারা। এখন পরিত্রাণ পাওয়ার বদলে আরও বেশি করের বোঝা তাদের ওপর চাপানো হচ্ছে। এটি হয়তো অর্থনৈতিক চাপে থাকা ব্যবসায়ীদের বেতন বাড়াতে বাধ্য করবে, অথবা কর্মচারীদের আরও বেশি বোঝাগ্রস্ত করবে," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
মি. বড়ুয়া বলছেন, সরকারের উচিত কর যারা ফাঁকি দেয় তাদের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়া, যারা নিয়ম মেনে চলে তাদের শাস্তি দেওয়া নয়।

চাকরিজীবীরা সহজ টার্গেট ?
রাজস্ব বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, দেশের বড় বড় করদাতারা, অর্থাৎ বৃহৎ করদাতা ইউনিটে নিবন্ধিত ব্যক্তি আছেন সাতশর কাছাকাছি বা সামান্য বেশি। এদের অর্ধেকেরও কম তাদের ফাইলে তিন কোটি টাকার সম্পদ দেখিয়েছেন।
এসব ধনীরা নিজেদের নামে সম্পদ না রাখায় তাদের কাছ থেকে বাড়তি কর আদায় করা যায় না।
অথচ এর বিপরীতে নির্দিষ্ট বেতনভোগীরা হলেন রাজস্ব বিভাগের সহজ টার্গেট, কারণ তাদের কাছ থেকে উৎসে কর বা অগ্রিম কর আদায় করতে কর কর্মকর্তাদের কোনো কষ্ট করতে হয় না।
এমনকি যারা একটু সঞ্চয় করতে চান তাদের আমানত ও সঞ্চয়পত্রের সুদের টাকা তোলার সময় অগ্রিম আয়কর কেটে রাখে ব্যাংক।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলছেন, বাংলাদেশের কর ব্যবস্থা পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরশীল, অর্থাৎ যার কোনো আয় নেই তাকেও বিভিন্ন পণ্য কেনার সময় কর দিতে হয়।
তার মতে, এখন যারা ঠিকমতো কর দেয় তাদের ওপরই চাপ বেশি। সে কারণে বাজেটে তাদের ওপর চাপ না বাড়িয়ে নতুন করদাতাদের করের আওতায় আনার ব্যবস্থা করলে সেটাই হবে প্রগতিশীল কর ব্যবস্থা।
"সরকার যে বর্ধিত কর আহরণ করবে সেটা প্রত্যক্ষ কর থেকে বেশি নিলে যারা এর মধ্যেই কর দেয় বা কর জালে আছে তাদের কাছ থেকেই নেবে, নাকি নতুন করদাতা নির্ধারণ করে তাদের কাছ থেকে নেবে সেটাই হবে এখন দেখার বিষয়। করের জাল সম্প্রসারণ করতে তারা কী ব্যবস্থা নেন তার দিকে আমাদের দৃষ্টি থাকবে," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
প্রসঙ্গত, প্রত্যক্ষ করের বড় উৎসই হলো বেতনভোগী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা, যার বেশিরভাগই আসলে বেসরকারি খাতের প্রতিষ্ঠানে কাজ করে। তাদের বেতন ছাড়াও প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্রাচুইটি সবকিছুই করের আওতায় রাখা হয়েছে।
প্রতিষ্ঠানগুলো বেতন থেকেই এসব ব্যক্তিদের করের টাকা কেটে সরকারকে দিয়ে থাকে। ফলে তাদের পক্ষে কর না দেয়ারও কোনো সুযোগ থাকে না।
অথচ ব্যবসায়ী, চিকিৎসক, আইনজীবীসহ বেশ কিছু পেশা আছে যেখানে অনেকের টিন নম্বর থাকলেও তাদের কাছ থেকে যে প্রকৃত আয়কর আদায় করা যাচ্ছে না, সেটি রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তারা নিজেরাই সবসময় বলে আসছেন।
পাশাপাশি ঢাকায় যাদের নিজস্ব বাড়ি ও ফ্ল্যাট আছে তাদের এই সম্পদের বিপরীতে কর নেয়া হচ্ছে যখন কেনা হয়েছে তখনকার হিসাবের ভিত্তিতে।

ফলে এখনকার বাজারমূল্যে এসব সম্পদ থেকে প্রকৃত আয়ের হিসাবে সরকার কর পাচ্ছে না।
অর্থাৎ একজন ব্যক্তির বাড়ি বা ফ্লাটের মূল্য যদি ১৯৯০ সালে এক কোটি টাকা হয়, তাহলে তিনি ২০২৫ সালে এসেও ওই একই মূল্যের ওপর কর দিচ্ছেন। অথচ ওই সময়ের তুলনায় এখন সম্পদের বাজারমূল্য ও এসব সম্পদ থেকে আয়ের পরিমাণ কয়েকগুণ বেড়েছে।
অথচ সংশ্লিষ্ট সব সরকারি সংস্থার কাছেই এসব জমি, ফ্ল্যাট বা সম্পদের মালিকদের তালিকা আছে, যেটি দেখে প্রকৃত আয় থেকে আয়কর নেয়া সম্ভব।
আবার মাঠ পর্যায়ে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ধনী কৃষক কিংবা মাছ ব্যবসায়ীর সংখ্যা অনেক বেড়েছে, যাদের অনেকের বার্ষিক আয় কোটি টাকারও বেশি। কিন্তু তাদের কাছ থেকে সরকার কার্যত কোনো আয়কর পাচ্ছে কি-না তা নিয়েই প্রশ্ন আছে।
আবার অনেক ব্যবসায়ীর টিন নম্বর থাকলেও এর বিপরীতে তার প্রকৃত আয় দেখিয়ে আয়কর না দেয়ার বিষয়টি রাজস্ব বিভাগসহ সবার জানা। উল্টো আয়কর হিসেবে নিজে যেটুকু দেন সেটুকু তারা মানুষের কাছ থেকেই তুলে নেন।
যেমন ধরা যাক, একজন ব্যবসায়ী ফল আমদানি করলে তার কাছ থেকে পাঁচ শতাংশ আয়কর হিসেবে নেয়া হয়। কিন্তু তিনি ওই কর ফলের দামের সাথে হিসেব করে ক্রেতার কাছ থেকে আদায় করেন।
ফলে বছর শেষে তার যে মুনাফা থাকছে বা আয় হচ্ছে তার ভিত্তিতে আয়কর তিনি নিজে দিচ্ছেন না, বরং তার পুরো আয়কর তিনি দাম হিসেবে ক্রেতার কাছ থেকে নিয়ে নিচ্ছেন।
এসব কারণেই এখন কার জাল সম্প্রসারণে কার্যকর ব্যবস্থা না নিয়ে যারা নিয়মিত অগ্রিম কর দিয়ে যাচ্ছেন তাদের ওপরেই করের বোঝা চাপানো "এক ধরনের শাস্তি" হবে বলে মনে করছেন আয়কর আইন বিশেষজ্ঞ স্নেহাশীষ বড়ুয়া।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক সদস্য এম আমিনুর রহমান বলছেন, করহার বাড়ানো একটা ধারাবাহিকতার বিষয়, যা সবসময় করা উচিত নয়। যদিও তিনি মনে করেন, সার্বজনীন পেনশন ও বেকারভাতার মতো বিষয়গুলো বিবেচনায় নিলে সরকারের আয় বাড়ানোর বিকল্প নেই।
"জ্বালানি, কৃষিসহ অনেক খাতে সরকারকে ভর্তুকি দিতে হয়। তবে গত কয়েক বছরে রিটার্ন জমা দেয়ার সংখ্যা অনেক বেড়েছে। তারপরেও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার কারণে অনেক ক্ষেত্রেই সঠিকভাবে কর আসছে না," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলছেন, "সরকার সামাজিক নিরাপত্তা খাত ও শিক্ষা খাতের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোতেও বরাদ্দ কমিয়েছে। এখন করের বোঝা বাড়িয়ে নির্দিষ্ট বেতনভোগী জনগোষ্ঠীর জীবনকে আরও দুর্বিষহ করতে চাইছে যা তাদের এখতিয়ার বহির্ভূত।"
বাজেটে আর কী থাকছে, কী জানা যাচ্ছে
সংবাদমাধ্যমের খবরাখবর অনুযায়ী আগামী অর্থবছর শেষে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ছয় শতাংশে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা তুলে ধরা হতে পারে।
তবে এই বাজেটে অল্প কিছু পণ্যে শুল্ক কমানোর সম্ভাবনা থাকলেও বাড়বে অনেক বেশি পণ্যে।
এছাড়া যথারীতি এবারের বাজেটেও ফ্ল্যাট ও বাড়ি কেনার খাতে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ থাকতে পারে।
পাশাপাশি জমি ও ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রেশন খরচও কমানো হতে পারে।
গত কয়েক বছরে বাজেটে এ সুযোগ রাখা নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারকে তুমুল সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিলো।
0 Comments